ময়ূখ
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
মুক্তিলাভ করিয়া ময়ূখ কাশেম খাঁর সহিত বাঙ্গালায় ফিরিয়া আসিলেন। বাঙ্গালার সুবাদারী গ্রহণ করিয়া কাশেম ইয়ার খাঁ হুগলীর পর্তুগীজগণের বিনাশের উদ্যোগ আরম্ভ করিলেন। সুবাদারের পুত্র এনায়েৎউল্লা সেনাপতি আল্লা ইয়ার খাঁর সহিত হিজলী আক্রমণ করিবার ছলে সসৈন্য বর্ধমানে পৌঁছিলেন। হুগলী আক্রমণের উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে পাছে হুগলীর পর্তুগীজগণ জলপথে পলায়ন করে, সেই জন্য মঙ্গুসাবাদে বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও নাওয়ারার সমস্ত কোশা ও গরাবের সহিত খাজা শের শ্রীপুর হইতে সুন্দরবনে প্রেরিত হইলেন। স্থির হইল যে, নাওয়ারা পর্তুগীজগণের জাহাজ যাইবার পথ রুদ্ধ করিলে আল্লা ইয়ার খাঁ বর্ধমান হইতে এবং বহাদর খাঁ কাম্বোহ মখসুসাবাদ হইতে হুগলীর দিকে অগ্রসর হইবেন।
এই সময়ে ফিরিঙ্গিগণ একদিন সপ্তগ্রামে গোকুলবিহারী শেঠের গৃহে আক্রমণ করিল। প্রতিশোধ লইবার জন্য গোকুলবিহারী ও সপ্তগ্রামের ফৌজদার হুগলী আক্রমণ করিলেন। যে দিন হুগলীর দুর্গ আক্রান্ত হইল, তাহার পরদিন রাঢ় হইতে ময়ূখ এবং বাড়ী হইতে বহাদর খাঁ গোকুলবিহারীর সহিত মিলিত হইলেন। এই সময় খাজা শের কোশা ও গরাব দিয়া সুন্দরবনের জলপথ রুদ্ধ করিয়া হুগলীর দিকে অগ্রসর হইলেন। তখন বর্ধমান হইতে এনায়েৎ উল্লা খাঁ ও আল্লা ইয়ার খাঁ হুগলী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ১০৪০ হিজরায় অর্থাৎ ১৬৩০ খৃষ্টাব্দে হুগলীর পর্তুগীজ দুর্গ চারিদিক হইতে আক্রান্ত হইল। পর্তুগীজ পাদ্রী ও ফিরিঙ্গি হার্মাদের অত্যাচারে প্রপীড়িত দক্ষিণ বঙ্গের অধিবাসিগণ দলে দলে বাদশাহী ফৌজে প্রবেশ করিল। বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও খশজা শের নৌকা সংগ্রহ করিয়া হুগলীর নিম্নে একটি নৌসেতু নির্মাণ করিলেন, ইহার ফলে হুগলী বন্দরের সমস্ত গরাব কোশা ও জালিয়া ডিঙ্গা বাদশাহী নাওয়ারা কর্তৃক ধৃত হইল। এইবার স্থলপথে পদাতিক ও জলপথে নৌসেনা হুগলী বন্দর ও দুর্গ আক্রমণ করিল, দুর্গের বহির্দেশে অবস্থিত নগর ও বন্দর আল্লা ইয়ার খাঁর দখলে আসিল।
তিন মাস যুদ্ধের পরে গোকুলবিহারী দুর্গ অধিকারের এক নূতন পথ আবিষ্কার করিলেন। গির্জার নিকটে হুগলী দুর্গের পরিখা সঙ্কীর্ণ ছিল, গোকুলবিহারীর নৌসেনা সুড়ঙ্গ কাটিয়া সেই স্থানের জল বাহির করিয়া দিল। তখন বাদশাহী সেনা ভীষণ বেগে সেই স্থান আক্রমণ করিল।
এই সময়ে আল্লা ইয়ার খাঁর শিবিরে পর্তুগীজ ফিরিঙ্গির এক নূতন শত্রু আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন আংরেজ বণিক্ পর্তুগীজ দস্যুর আক্রমণে হৃতসর্বস্ব হইয়া গোয়ায় আসিয়াছিল; তথায় পর্তুগীজ পাদ্রীগণের অত্যাচারে তাহার চক্ষুর্দ্ধয় নষ্ট হইয়াছিল। দৈবচক্রে হুগলী দুর্গ অবরোধের সময় সেই অন্ধ আংরেজ বণিক সপ্তগ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে স্বদেশে যুদ্ধব্যবসায়ী ছিল, সুড়ঙ্গ কাটিয়া বারুদ প্রয়োগে কিরূপে দুর্গপ্রাকার ধ্বংস করিতে হয় সে তাহা ফরাসী দেশে শিক্ষা করিয়াছিল। তাহার সাহায্যে ময়ুখ গির্জার নিম্নে সুড়ঙ্গ কাটিয়া দুর্গপ্রাকার ধ্বংসের চেষ্টা করিতে আরম্ভকরিলেন। দুই-তিন বার ব্যর্থমনোরথ হইয়া অন্ধ আংরেজ অবশেষে এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিল; তাহাতে শত শত মণ বারুদ সঞ্চিত হইল। ভয়ে কোনও মুসলমান বা হিন্দু সেনা সেই বারুদ রাশিতে অগ্নিসংযোগ করিতে স্বীকৃত হইল না। তখন সুবাদারের একজন দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ আহদী স্বেচ্ছায় সেই ভার গ্রহণ করিল।
চারিদিকে বাদশাহী ফৌজ দুর্গ আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল, তখন সেই আহদী হল্দীপুরের শিবিরে আসিয়া ময়ূখের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিল। ময়ুখ তখন আল্লা ইয়ার খাঁ, এনায়েৎ উল্লা খাঁ, খাজা শের ও বহাদর খাঁ কাম্বোহের সহিত পরামর্শ করিতেছিলেন। একজন সওয়ার আসিয়া তাঁহাকে কহিল, "মহারাজ, সেই হিন্দু শহীদ আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন।"
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি