মহীসারে মহাগোল
আখতার ফারুক ইসলাম
প্রচ্ছদ - অরিজিৎ ঘোষ
প্রকাশক : সৃষ্টিসুখ (হ য ব র ল)
--------------
কিশোর-উপন্যাস লিখতে এসে আখতার ফারুক ইসলাম বেছে নিয়েছেন সেই ধারাটি, যেটা এতদিন আমরা পেয়েছি শীর্ষেন্দুর অদ্ভূতুড়ে সিরিজে। সেই চোর, ডাকাত, কাপালিক, রাজবাড়ি এবং অবশ্যই গুপ্তধন। ভূত না থাকলেও সেই খামতি পুষিয়ে দিয়েছেন খামখেয়ালি এক ইতিহাস শিক্ষক আর পেটমোটা এক দারোগা।
মহীসারে মহাগোল-এ মুখোশপরা ভিলেনের পরিচয় একেবারে শেষে পাওয়া গেলেও হিরো কিন্তু গল্প বলার সরস স্টাইলটি। ধাঁধার জট ছাড়িয়ে গুপ্তধনের পেছনে ছুটে চলার শেষে কী হতে পারে তা আমরা আগেই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ার গতি তাতে একটুও শ্লথ হয় না।
==========
কথাটা হচ্ছিল মহীসারের বিখ্যাত বটতলার বাঁধানো বেদীতে। মোটামুটিভাবে গাঁয়ের সকল মাথা মুরুব্বির দল তাঁদের দৈনিক খাদ্য পাচনের উদ্দেশ্যে এখানে নিয়মিত উপস্থিত হন। মহীসারে অনেকদিন কোনও চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। চোর পড়ার কথা শুনে ইংরেজি শিক্ষক বিশ্বনাথবাবু মনে মনে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। যাক, শেষ পর্যন্ত গ্রামে তাহলে লোমহর্ষক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু যখন শুনলেন সেই গবেট চোর মাধববাবুর বাড়িতে ঢুকেছিল আর এক হাঁকডাকেই শেষমেশ পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছে, তিনি চাপা দুঃখের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গভীর খেদের সঙ্গে বললেন, “চরম অপমানজনক ঘটনা মশাই। হাইলি ইনসাল্ট। চোর বলে কি তার কোনও কর্তব্যবোধ নেই? ভিলেজে আর সবাই তো মরে যায়নি। কেন কাছেই তো মহীতোষবাবুর হাইলি কস্টেড বাড়িটা ছিল। কই সে বাড়িতে তো ঢুকতে গেল না। আর বাজারে সনাতন ঘোষের গোল্ডের দোকানটাই বা কী ক্ষতি করল? কাল রাতে তো নাসির সাহেবের হাউসটা ফাঁকাই ছিল, কই সেদিক পানে তো নজরও গেল না? এইসব রাঘব বোয়ালদের বাদ দিয়ে শেষমেশ চুনোপুঁটিতে হ্যান্ড। ছ্যাঃ ভিলেজের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে গেল দেখছি।”
ইতিহাসের শিক্ষক গোবর্ধনবাবুও ঘটনায় কম দুঃখ পাননি। ব্যাজার মুখে বললেন, “বিশ্বনাথবাবু ঠিকই বলেছেন। মহীসারের গৌরবময় দিনে আজ একটা কলঙ্কের ছাপ পড়ল। ছেলেবেলায় দেখেছিলাম পাঁচু চোরকে। কী তার হাত! কী তার শিল্পকর্ম! আপনি শুয়ে থাকবেন আর আপনার তলা থেকে বালিশ, তোশক, এমনকী খাটশুদ্ধু আপনাকে লোপাট করে ফেলবে, তবুও আপনি টেরটিও পাবেন না। নাহ, এই শিল্পটাও দেখছি সিন্ধু সভ্যতার মতো আজ ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে।”
বটতলার বেদীর আরেক সদস্য আজিজুল ভাই এবার মুখে দুঃখসূচক শব্দ করে বললেন, “আমাদের শিবেন চোরই বা কম কীসে? এখন বুড়ো হয়ে গেছে বটে, তবে সেদিন বুড়ো হাড়ে যে খেল দেখাল মশাই... ওহ! দেখে চোখ সার্থক হয়। বোসবাড়িতে লোকলস্কর যখন চারিদিক থেকে তাকে জাপটে ধরল, তখন শিবেন বাবা কী রকম সাপের মতো লম্বা খোলস ছেড়ে পালাল। আহা সেসব ভেবেও মন শান্তি পায়। হায় রে! আর কি সেসব দিন ফিরে আসবে?”
আলোচনাসভার প্রবীণতম সদস্য গোবিন্দবাবু নাকের ফুটোয় নস্যি গুঁজে বললেন, “তবে যাই বলো, আমার মনে হয় কাপাসডাঙ্গার সাধু-চোর ভণ্ডরাজের কাছে এরা সবাই নস্যি। যোগী পুরুষ ছিলেন। নিজের শরীরের প্রতিটি অংশ মোটরগাড়ির মতো প্যাঁচ দিয়ে খুলে ফেলতেন আবার প্রয়োজনে স্ক্রু দিয়ে এঁটে নিতেন। তো সেবার হল কী, বাবাজী চুরি-টুরি করে অন্য রাস্তায় জানালার শিক গলে পালাতে গিয়ে হল এক বিপদ। হাত-পা সব খুলে জানালার ভিতর দিয়ে বাইরে পাচার করে ফেললেন, কিন্তু শেষে মাথাটা গেল আটকিয়ে। মাথা আর বের করা যায় না। আবার মাথা না হলে তো কাজকর্ম চলবেও না। কী বলো?”
আসরের সবাই এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। আজিজুল ভাই একটা ঢোঁক গিলতে গিয়ে বিকট ঘোঁত শব্দ করে বলল, “তাহলে খুড়ো, সে রাতে বাবাজী উদ্ধার পেলেন কী করে?”
গোবিন্দবাবু নাকে আর এক টিপ নস্যি গুঁজে বললেন, “সে রাতে ভণ্ডবাবার যে কী কষ্ট চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। মাথাটা প্যাঁচ দিয়ে খুলে ঘরের মধ্যেই একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখলেন। পরের রাতে আবার অন্য রাস্তায় গিয়ে মাথাটা চুরি করে আনতে হল।”
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি