নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন
জ্যোতির্ময় দাশ
প্রচ্ছদ : অসীমকুমার
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৩০৪
বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট ও দুটি স্বদেশি গানের উন্মাদনা
১৯০৫-এ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আমলে বঙ্গদেশ বলতে যে-প্রেসিডেন্সি বা প্রদেশ তা ছিল সংযুক্ত বাংলা, বিহার, ওড়িশা ও ছোটোনাগপুরের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। তারও আগে একসময়ে এই বঙ্গদেশের সঙ্গে আসামও যুক্ত ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৭৪ সালে বাংলা থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করে এক স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হয়।
আসাম বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও বঙ্গপ্রদেশের যে-অংশটা থেকে যায় সেটাকেও আয়তনে হ্রাস করে ও খণ্ডিত করার চিন্তার নতুন করে সূত্রপাত হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। কারণটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন গড়ে তোলা। এই অভিসন্ধিটি উত্থাপন করেছিলেন সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম ডিভিশনের কমিশনার ডবলিউ বি ওল্ডহ্যাম; ১৮৯৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি সে-সময়ের বাংলার চিফ সেক্রেটারিকে লিখেছিলেন বাংলাকে ভেঙে ছোটো করলে যে-সুবিধা হবে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা। তাঁর কূটনৈতিক চাল ছিল মুসলিমদের একত্রিত করে শক্তিশালী করে তোলা:
টু ইউনাইট দ্য মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পার্ট অফ দ্য মোহম্ম্যাডান পপুলেশন
অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া।
আট বছর বাদে ১৯০৪ সালে ভারত সরকারের সচিব এইচ এইচ রিসলে এই প্রতিবেদনটির সপক্ষে মন্তব্য করেছিলেন এবং বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকে ত্বরান্বিত করতে লিখেছিলেন:
বেঙ্গল ইউনাইটেড ইজ এ পাওয়ার; বেঙ্গল ডিভাইডেড উইল পুল ইন সেভারল ডিফারেন্ট ওয়েজ। দ্যাট ইজ পারফেক্টলি টু অ্যান্ড ইজ ওয়ান
অব দ্য মেরিটস অফ দ্য স্কিম।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিখ্যাত 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির সূত্রের এখান থেকেই সূচনা। এই ভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে তাল মিলিয়েছিলেন বাংলার সে-সময়ের গভর্নর বা ছোটোলাট স্যার অ্যান্ড্রু ফেজার।
দুই
ইংরেজ শাসকরা মনে করেছিল: 'দ্য নেটিভস্... উইল কুইকলি বিকাম অ্যাকাস্টমড টু দ্য নিউ কন্ডিশনস।' কিন্তু শাসকেরা দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেনি। ১৯০৫ সালের জুলাই থেকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন তার সাধারণ প্রতিবাদের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসে এক প্রবল প্রতিরোধের আর সংগ্রামের চেহারা নিল। শহরের শিক্ষিত ও ধনী মানুষজনের সঙ্গে গ্রামের অশিক্ষিত এবং নির্ধন জনগণ যুক্ত হওয়ায় এই আন্দোলন ক্রমশ স্বদেশি আন্দোলনে পরিণত হয়ে ওঠে এবং সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে স্বরাজের দাবি ওঠে।
এই রাজনৈতিক প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক ও সংগ্রামী দিকটির সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের দিকেরও আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছিল। সমগ্র বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তাঁদের কলমকে শাণিত তরোয়াল করে তুলেছিলেন এবং 'কলম যে তরোয়ালের থেকে শক্তিশালী' সেই কিংবদন্তিপ্রতিম প্রবাদটিকে আক্ষরিক অর্থে সার্থক করে তোলেন। এই সময়ে কত অজস্র যে দেশপ্রেমের গান ও কবিতা লেখা হয় তার প্রামাণ্য বিবরণ নিঃসন্দেহে এক পূর্ণাঙ্গ গবেষণাপত্রের বিষয় হতে পারে। আমরা এই নিবন্ধে দেশাত্মবোধক সংগীতের মুক্তোমালা থেকে সর্বাধিক জনপ্রিয় কেবল দুটি মাত্র গানের সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।
কবিরা ক্রান্তদর্শী হয়ে থাকেন। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসকদের কূটনৈতিক চালটি বুঝতে পেরেছিলেন- বাংলাকে বিভাজন করে বিদেশি শাসকেরা বাঙালিদের হীনবল করা ও হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিকে কলুষিত ও বিষাক্ত করে তোলা। কবিগুরু তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী করার দিনটিকে (১৬ অক্টোবর ২০০৫) জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে এক মৈত্রীর সূত্র গড়ে তুলবেন। তিনি ওই দিনটিতে রাখীবন্ধনের ডাক দিলেন। এই উপলক্ষ্যে তিনি একটি নতুন গান রচনা করেছিলেন যেটি পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক 'রাখী-সংগীত' নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিল। গানটি এই ধরনের ছিল:
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান-
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ...
অন্য গানটি ছিল ---
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই
দীন-দুখিনী মা যে তোদের
তার বেশি আর সাধ্য নাই।
ওই মোটা সুতোর সঙ্গে, মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই; আমরা এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ওই পরের দোরে ভিক্ষা চাই। ওই দুঃখী মায়ের ঘরে, তোদের। সবার প্রচুর অন্ন নাই, তবু তাই বেচে, কাচ সাবান মোজা কিনে কল্লি ঘর বোঝাই। আয়রে আমরা মায়ের নামে এই প্রতিজ্ঞা করব ভাই-পরের জিনিস কিনব না, যদি মায়ের ঘরের জিনিস পাই।
এই একটি মাত্র গান রজনীকান্তকে যে-জনপ্রিয়তা এনে দেয় তা তুলনাবিহীন এবং অভাবনীয়। এই গানটি নিয়ে সে সময়ের বিদগ্ধ সাহিত্যিক মহলে যে-স্পন্দন উঠেছিল তার থেকে কয়েকটি মাত্র এখানে উদ্ধৃত করা হল সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছিলেন:
কান্তকবির 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়' নামক প্রাণপূর্ণ গানটি স্বদেশী সংগীত সাহিত্যের ভালে পবিত্র তিলকের ন্যায় চিরদিন বিরাজ করিবে। বঙ্গের এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত এই গান গীত হইয়াছে। ইহা সফল গান। যে সকল ক্ষুদ্র-প্রাণ প্রজাপতির ন্যায় কিয়ৎকাল ফুলবাগানে প্রাতঃসূর্যের মৃদু কিরণ উপভোগ করিয়া মধ্যাহ্নে পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া যায়, ইহা সে শ্রেণীর অন্তর্গত নহে। যে গান দৈববাণীর ন্যায় আদেশ করে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর মতো সফল হয় ইহা সেই শ্রেণির গান।....
জ্যোতির্ময় দাশ কবিতা, রম্য রচনা, ও অনুবাদ চর্চায় স্বনামধন্য হলেও তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থে ৪২ টি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ লিখেছেন, যা পাঠ করলে সাহিত্য তথা ছোটো পত্রিকা নিয়ে একটা বিস্তৃত ধারণা জন্মায়।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি